Saturday, November 23, 2024
মতামত

পুলিশের ছুটি নেই, তবুও ছুটে চলা

নিদারুণ দুঃসময়ের মধ্যে আমরা প্রতিটি ক্ষণ পার করছি। প্রতিদিন করোনার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। এমন ভয়াবহ করুণ সময় হয়তো আগে পার করিনি। এমনি হতাশা, উদ্বেগ, উৎকন্ঠার মধ্যে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনী। সম্প্রতি করোনাকালীন পুলিশের ভুমিকা প্রশংসনীয়। তাদের এই মানবিক কাজ আমাদের শক্তি যোগায়, আশার আলো দেখতে পাই আমরা।

রাত কিংবা দিন, ঝড় অথবা বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছুটে চলছে পুলিশ। ছুটি নেই তবুও তাদের অবিরাম ছুটে চলা। মানুষের সচেতন করতে, এই দেশকে করোনার থাবা থেকে রক্ষা করতে তাদের এই বিরামহীন মানবিক কাজ সারাদেশে পুলিশকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে। আমরা যখন আমাদের পরিবার নিয়ে রাতে ঘুমাই, তারা তখন পরিবার ছেড়ে র্নিঘুম রাত কাটায়।

এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে পুলিশের কাছে ফোন আসল। বাসায় খাবার নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অল্প বেতনের চাকরি করা পরিবারটি বাধ্য হয়ে পুলিশের কাছে খাবার চাইল। রাতের আঁধারে তার বাসায় পৌঁছে দিল খাবার। এ বিষয়ে বেসরকারি এক টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার এ মো. জুলফিকার আলি, (সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার, খিলগাঁও জোন, ডিএমপি) বলেন, অনেক ফোন আসছে, আমরা নিজেদের উদ্যোগে তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।

করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফনে যখন তার পরিবারের কেউ ভয়ে যাচ্ছে না তখন দেখা গেছে শেরপুরে পুলিশের সদস্যরা জানাজাসহ লাশ দাফনের কাজে। এ যেন এক মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পটুয়াখালী জেলার এক পুলিশ সদস্য জাহিদুল ইসলাম করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন এবং নদী ভাঙন এলাকায় অসহায় মানুষের দাফনের জন্য নিজের ১৭ শতাংশ জমি দান করেছেন। সমাজের বিত্তবানদের জন্য এটি উদাহরণ নয় কি?

ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের উদ্যোগে জেলার ইমাম-মোয়াজ্জিম, পুরোহিত ও সেবায়েতদের মাঝে সহায়তা সামগ্রী বিতরণ করেন। সামাজিক দূরত্ব বজায়, সুশৃঙ্খলভাবে এসব উপহার সামগ্রী বিতরণ সারাদেশে আলোচিত হয়েছে। যশোর জেলা পুলিশের উদ্যোগে গানে গানে মানুষের সচেতনতা এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে সচেতনতার। লোকডাউনের এই সময় নিরলস পরিশ্রম যশোর জেলার লকডাউন বাস্তবায়নে ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনাভাইরাস পরীক্ষার কাজে এক নিবেদিত ৩০ বছরের যুবকের নাম বিভুতিভুসন। তার অকৃত্রিম সেবার মানসিকতায় মুগ্ধ হয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শাহবুদ্দিন খান প্রেরণ করেন উপহার সামগ্রী। যা যেকোনো মানুষের কাজের অনুপ্রেরণা জোগাবে।

আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, বরগুনা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহজাহান হোসেনের একটি ভিডিও। তিনি কৃষকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি যারা করে তাদের হুঁশিয়ার করে দেন। বলেন, “আমি থাকতে কোন চাঁদাবাজি নয়”। যা সারাদেশে কৃষকদের এক আশার বাণী।

করোনা আমাদের পুলিশের মানবিক দিক চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। নিজেদের পরিবারের চেয়ে যেন আমাদের পরিবারদের বড্ড বেশি ভালোবাসে। এরই ধারাবাহিকতায় নীলফামারী জেলা পুলিশ সারা দেশে ধান কাটার জন্য প্রায় ২৫০০ অধিক শ্রমিক পাঠাতে সহযোগিতা করেছে। দেখা গেছে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ, পরিবহন ব্যবস্থা করে দিতে। সম্প্রতি ঈশ্বরদী থানা পুলিশ তাদের নিজেদের রেশন ৪৫০ জন পরিবারের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছে। এ যেন বিপদে বন্ধুর কাছে পাওয়া।

পুলিশ সার্জেন্ট শেখ হাবিব ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে দায়িত্ব পালন করেন। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে হাসপাতালে যাওয়া একজন বাইক আরোহীর মোটরবাইকের তেল শেষ হয়ে যাওয়ায়, নিজের বাইকের তেল দিয়ে সেই বাইক আরোহিকে চরম বিপদ মুহূর্তে সাহায্য করা নজিরবিহীন। অসহায় মানুষের পাশে পুলিশ, হাসপাতালে অসহায় রোগীকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ- এমন সংবাদ আমাদের উৎসাহিত করে।

শুধু মানুষের মাঝে নয়, পশু পাখির জন্যও যেন পুলিশের দায়িত্ব থেমে নেই। চট্টগ্রামে এক পুলিশ সদস্য রাজিব কুমার রায় দুর্গন্ধ-পঁচা পানিতে নেমে এক কুকুরছানাকে বাঁচাতে দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই ছবি ভাইরাল হয়েছে। কুকুরছানার জন্য মা কুকুরটি অসহায়ের মতো চিৎকার করছিল। রাজিব কুমার পুলিশের দায়িত্বরত অবস্থায় নিজেকে মানবিক পরিচয় দিল। সম্প্রতি এই গ্রীষ্মকালেও কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ লাইন্সের এক জলাশয়ে মিলেছে পাখিদের মিলনমেলা। পাখিগুলো যেন পুলিশের কাছে এই মহামারী সময় নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। এ সংবাদটি চ্যানেল আইয়ে প্রচার হয়েছিল গত ২৮ এপ্রিল।

এমনি অনেক ঘটনা আমাদেরকে দেখিয়ে দিল পুলিশ আজ বিপদের বন্ধু। সবার মাঝে, সবার কাছেই পুলিশ আজ প্রশংসার দাবিদার। তাই তো রাজধানীর একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া আয়ান তার মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা এই করোনার সময় পুলিশের কাছে তুলে দিতে বাহানা ধরল। তার বাহানা– ‘বাবা আমাকে পুলিশ আংকেলদের কাছে নিয়ে যাও, আমার জমানো এই টাকা তাদের কাছে দিব আমি’। ছেলের বাহানায় বাবা বাধ্য হয়ে মিরপুর মডেল থানায় ৮ বছরের ছোট ছেলেকে নিয়ে তুলে দিল ছেলের জমানো টাকার মাটির ব্যাংকটি। আমরা সংবাদমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি পুলিশের এই করোনায় নানাবিধ সামাজিক, মানবিক কাজ। যখন আমরা এই পবিত্র রমজানে ঘরে ইফতার করি পরিবার নিয়ে, পুলিশ তখন আমাদের নিরাপত্তার জন্য পথে ঘাটে সামান্য কিছু খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ইফতার করে। তারা ঘরের বাইরে থাকে, আমাদের নিরাপত্তায় ঘরে রাখতে।

আগে আমরা দেখেছি পুলিশের বাইরের কঠোরতাকে। কিন্তু দেখিনি বুটের ভেতর পায়ের রক্তজমাট বাধা। আমরা নানান নেতিবাচক ঘটনা শুনেছি, কিন্তু দেখিনি পুলিশের পোশাকের ভিতর শরীর বেয়ে পরা ক্লান্তির ফোঁটা।

এই করোনা আমাদের দেখিয়ে দিলো, পুলিশের পোশাকজুড়ে যেন থাকে এক বাংলাদেশকে মমতার চাদরে জড়িয়ে রাখা। পুলিশের এই মানবিকতা, উদারতা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বিপদে বন্ধুর নামই পুলিশ।। আমরা উপলব্ধি করেছি দুঃসময়ে হাল ধরা এক নাবিক পুলিশ।। পুলিশের এই মানবিকতা অব্যাহত থাকুক এই প্রত্যাশা।

সবশেষে ডিএমপির পুলিশ অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) দক্ষিণে কর্মরত এএসআই আব্দুল খালেক, ট্রাফিক উত্তরের এয়ারপোর্ট এলাকায় কর্মরত কনস্টেবল আশেক মাহমুদ এবং কনস্টেবল জসিম উদ্দিনের করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় মহান আল্লাহর কাছে তাদের জান্নাতের জন্য ফরিয়াদ করছি।

লেখক: ব্যাংকার ও তরুণ লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *