মানবিক পুলিশ হওয়াও কি দোষের?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এক গৃহহীন মা তাঁর ক্ষুধায় কাতর দুই সন্তানের জন্য সুপারশপে যেয়ে ব্রেড চুরি করে ধৃত হবার পর, সুপারশপের শেয়ারহোল্ডার স্থানীয় পুলিশকে অবগত করেন।
অফিসার ওই অসহায়, গৃহহীন মায়ের সামনে দাঁড়াতেই মহিলা চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিয়ে বলতে থাকেন, আমি হতভাগী মা দুইদিন ধরে নিজ সন্তানের মুখে অন্ন জোগাতে পারিনি তাই চুরি করতে বাধ্য হয়েছি। পেশাদার সেই পুলিশ সদস্য চোখের কোণে একটু হাত দিয়ে পরমুহূর্তেই অভিযোগকারীকে বলেন আমি যদি তোমার পণ্যের মূল্য পরিশোধ করি, তোমার কি আর কোনো অভিযোগ থাকবে? তিনি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। না তাঁর কোনো দোষ নেই, তিনি বরং সঠিক ভূমিকাই পালন করছিলেন! পরবর্তী সময়ে পুলিশ সদস্য আরও কিছু কেনাকাটা করে ওই মাকে নিয়ে সুপারশপ থেকে বের হওয়ার সময় উপস্থিত জনতাকে বললেন, আমি, তুমি যেখানে আমার এই বোনের খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পারিনি, সেখানে আইনের প্রয়োগও যথাযথভাবে আমি করতে অক্ষম!
এতটুকু মানবিক আমরা তো হতেই পারি? একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে সবসময় “মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়”
আমাদের সমাজে কেউ স্বভাবে দোষী আর কেউ কেউ হয় অভাবে দোষী! পিআরবি(পুলিশ রেগুলেশনস অব বেঙ্গল) তে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বলা আছে, আপনি নিম্নপদস্থ সদস্যদের ভুল,ভ্রান্তি অবশ্যই বিবেচনায় আনবেন কিন্তু ছিদ্রান্বেষী হয়েন না! এই বিষয়টি অভ্যন্তরীণভাবে মেনে চলার পাশাপাশি, আমাদের একটি বিশাল অংশ মাঠে, ঘাটে যারা কাজ করি তাঁরা বাহিরে মাঠে গিয়েও ছিদ্র অন্বেষণ করার এই মানসিকতা, বর্জনের যথেষ্ট চেষ্টা করছি।
অভাবের দোষীদের একটু মানবিক সুযোগ প্রদান যদি তাকে আগামীতে রাষ্ট্রের বোঝা হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয়, তবে সেটিকে রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর সিদ্ধান্ত বিবেচনা করতেই আমার ব্যক্তিগত মন সায় দেয়! স্বভাবের দোষীদের জন্য আইন সরব হোক, সেটিই বরং কাম্য!
তীব্র জলোচ্ছ্বাসের কারণে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলে কেউ নিরাপদস্থলে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে, আর কেউ কেউ তাঁর সর্বস্ব নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে! সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা না থাকলে সেই বাঁধ কিন্তু আর টেকে না! যদি সম্মিলিত প্রচেষ্টার পরও না টেকে সেই বাঁধ, তাও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে সেটি ইতিহাস হয়ে থাকে।
৭ ই মার্চের ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে….! মহান নেতা তাঁর বিচক্ষণতা দিয়ে যথার্থই বুঝেছেন দেশ স্বাধীন করতে হলে সকলের সমান অংশীদারিত্ব অপরিহার্য!
দুর্যোগে কে এলিট, আর কে মাঠে, ঘাটে কাজ করা লোক এই শ্রেণিবিভাজন করে টিপ্পনি কাটা মানুষের জন্য আমার সত্যিকার অর্থে একইসাথে করুণা ও মায়া হয়। দেশ ও দেশের মানুষের সেবা দানের মানসিকতা থাকলে দুঃসময়ে মানুষের জন্য গৃহীত মানবিক কাজের সমালোচনা যিনি করতে পারেন, তাঁর কাছে অসহায়ের অসহায়ত্ব কতটুকু মূল্য রাখে তা আমার জানা নেই!
আশ্চর্য হই, এই আপনারা যখন বারবার করে বলছিলেন, আমরা আমাদের মানবিক পুলিশ চাই! যখন সেই পুলিশেরা মানবিকতার দৃষ্টান্ত রেখে প্রতিনিয়ত কাজ করা শুরু করলো এই আপনার জন্য, ঠিক তখন আপনাদের কারো কারো গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেলো! কৃষকের পাকা ধান কেটে দিতে সাহায্য করায় এই আপনি টিপ্পনী কেটে বলছেন, কৃষক হয়েছে নাকি? মানুষের বাড়িতে বস্তা বহন করে খাবার পৌঁছে দেয়ায় আপনার কাছে পুলিশ হয়েছে শ্রমিক। যে কৃষকের খাদ্যের উপর আমার দেশ, এই লকড ডাউনে সেই কৃষকের পাশে পুলিশ না দাঁড়ালে শ্রমিক কি মঙ্গলগ্রহ থেকে উড়ে উড়ে আসতো? খাবারের প্লেটে প্রতিদিনের যে রসনা তা কিন্তু উবে যাবে মশাই! এটি ভুলে গেলে তো চলবে না, খাদ্যের হাহাকারে সংঘটিত অপরাধ থামাতে মাঠে আবার পুলিশকেই থাকতে হবে?
প্রোএ্যাকটিভ কর্মযজ্ঞ কি ও কাকে বলে, একটু জেনে নেবেন! এই দুর্যোগে ডাক্তার, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি একক পেশাজীবি হিসেবে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যায় রয়েছে পুলিশ! বোধোদয় কি এখনো হয়না জনাব, সাধ্যের কতটুকু দেবার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ পুলিশ?
পুলিশ কোথায় কাজ করছে সেটির ফিরিস্তি আর দিতে চাইনা! নিজেদের পেশাগত কাজের বাইরে যেয়ে আরও কত, শতজনের কাজে পুলিশের এই এগিয়ে যাওয়াতেই সমাজের সুশৃঙ্খলতা এখনো দৃশ্যমান! পুলিশের সদস্যরা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে সর্বত্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করে চলেছে নিরলসভাবে। নিজেদের বেতনের টাকা আর রেশন দিয়ে মানুষের পাশে দাড়ানোর এই মানবিক মানসিকতাকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইতে পারে, ঘুনাক্ষরেও মাথায় কাজ করেনি! এই ঘৃণ্য মানসিকতা যিনি ধারণ করেন তাকে বলতে ইচ্ছে হয় “মানুষ তুমি মানুষ হবে কবে”?
যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রতিটি হাতের এক হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে, এর ভিন্ন প্রচেষ্টা রাষ্ট্রকে ঝুঁকিতে ফেলে! সর্বাধিক সংখ্যক এই মানসিকতা নিয়ে কাজ করছেন বলেই এখনো আমরা স্বপ্ন দেখি এবং দেখতে ভালবাসি! সংখ্যাধিক্যের বিচারে এরুপ মানসিকতা ধারণকারী এই আপনি, আপনারা নিজের পেশাগত অবস্থান থেকে যতটুকু কাঁদা ছুঁড়ছেন মনে রাখবেন, এটি আপনার ব্যক্তিগত ও পেশাগত মর্যাদাকে হেয় করছে!
নিজে ভাল করুন এবং অন্যের ভাল করাকে উৎসাহিত করুন! আর তা যদি স্বভাবজাত কারণে নাই করতে পারেন, তবে দয়া করে চুপ থাকুন!
লেখক : অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন), ওয়ারী বিভাগ, ডিএমপি, ঢাকা।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)