মানবিক বাংলাদেশ ও বিতাড়িত রোহিঙ্গা
গণমাধ্যমের কল্যাণে রোহিঙ্গা নারী খাদিজার গল্পটি এখন অনেকের জানা। খাদিজার বাবা ও স্বামীকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা খাদিজা ও তার মা জীবন নিয়ে কোনো রকম পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে। পালিয়ে আসার এই দীর্ঘ পথ তাদের জন্য সুখকর ছিল না। মৃত্যুর ভয় ছিল পদে পদে। পেছনে বন্দুক হাতে মিলিটারি-মগ, পায়ের তলায় পোঁতা স্থলমাইন। জন্মভূমি তাদের জন্য আজ মৃত্যুকূপ। কোনো রকম পালাতে পারলেই বেঁচে যাবে তারা। পূর্ব পুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মৃত্যুভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। খাদিজারাও পালাল।
তারা জানতে পেরেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বড় মনের মানুষ। তাদের এই দুঃখ-দুর্দিনে তাঁর দেশের সীমান্ত খোলে দিয়েছেন। বাঁচার আকুতিতে পালিয়ে আসা সম্বলহীন লাখো রোহিঙ্গাকে তিনি নাফ নদে ভাসিয়ে দেননি। বরং আশ্রয় দিয়ে, নিজেদের খাদ্যের ভাগ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা খাদিজার পরিবারও আশ্রয় পেল একটি আশ্রয়শিবিরে। সেখানেই জন্ম নেয় খাদিজার সন্তান। খাদিজা এ দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞাস্বরূপ সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের নাম রাখল শেখ হাসিনা। এটা শুধু একটি নাম নয়। এর সঙ্গে মিশে আছে ভিন্ন একটি দেশের মানুষের আবেগ, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা। মানুষের এই পবিত্র ভালোবাসার সঙ্গে পৃথিবীর কোনো সম্পদের তুলনা হয় না।
রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার জন্য কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের উদ্যোগে একটি প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণকেন্দ্র চালু করা হয়। উদ্বোধনের দিন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কেন্দ্রে নারী ও পুরুষ ডাক্তারের দুটি আলাদা টিম কাজ করছিল। মানুষের ভিড় লেগেই আছে। হঠাৎ কয়েকজনে ধরাধরি করে একজন অসুস্থ নারীকে কেন্দ্রে নিয়ে এলো। মেয়েটির নাম মাসুমা। সঙ্গে থাকা লোকজন জানাল, মিয়ানমারে তার গ্রামে গতকাল সে একটি মৃত বাচ্চা প্রসব করেছে। গ্রামের অবস্থা এতই খারাপ যে তাকে বাঁচার জন্য এই শরীর নিয়েই পালিয়ে আসতে হয়েছে। সে ভেবেছিল হয়তো আর বাঁচবে না। সে মারা যাবে মিলিটারির হাতে, নয়তো পথে অসুস্থ হয়ে। কিন্তু তাকে যখন জানানো হলো মিয়ানমারের সীমানা পার হয়ে তারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে, তখন থেকেই তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। চিকিৎসার বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটির মুখের দিকে আমিও তাকাই, নিষ্প্রভ মুখে আধখানি হাসি, এই হাসি পরম নির্ভরতার, মৃত্যুর খুব কাছ থেকে বেঁচে ফেরার হাসি। যেই দেশের সেনারা তাকে অস্ত্র হাতে তাড়া করেছিল, সেই দেশের সীমানা সে পেছনে ফেলে এসেছে। বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ভয়ও ছিল কিন্তু এখন সে এখানে চিকিৎসা পাচ্ছে। এ যাত্রায় বেঁচে যাবে সে—এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! বাংলাদেশই তার কাছে স্বর্গ।
এ তো শুধু খাদিজা আর মাসুমার কথা। কত শত খাদিজা-মাসুমা সব হারিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। ক্যাম্পগুলোতে যারা আশ্রয় নিয়েছে তার বেশির ভাগই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী ৮০ হাজার গর্ভবতী নারী রয়েছে। সেনাবাহিনী মা-বাবা দুজনকেই হত্যা করেছে এমন শিশুর সংখ্যাও কম নয়। জীবন বাঁচাতে বয়স্ক মানুষগুলোকেও কাঁধে বয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। অথচ একসময় তাঁদের ঘর ছিল, সুন্দর ও সচ্ছল সংসার ছিল। সবাই ছিল। কিন্তু সংসারের সামর্থ্যবান পুরুষদের সেনাবাহিনীর লোকেরা হত্যা করেছে। যুবকদের ধরে নিয়ে গেছে। যুবতীদের ধর্ষণ করেছে, কাউকে কাউকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। বাকি যারা ছিল তারা জীবন নিয়ে পালিয়েছে, আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। আজ সব হারানো পালিয়ে আসা আশ্রিত মানুষের আহাজারিতে টেকনাফ-উখিয়ার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এ যে কী ধরনের মানবিক বিপর্যয়, তা নিজের চোখে না দেখলে বোঝানো যাবে না। প্রায় সময় ভাবি, যে আগুন রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে জ্বলছে, সে আগুনে যদি গোটা মিয়ানমারে ছড়িয়ে যেত, বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হতো যদি মিয়ানমার সেনাবাহিনী, তবে কি মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে এসব মানুুষ জীবন বাজি রাখত না? দেশের প্রয়োজনে কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করত তারা। এমনকি জীবন দিতেও দ্বিধা করত না। অথচ যে জন্মভূমিকে মানুষ জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, সেই জন্মভূমি থেকেই হাজার হাজার বছরের পূর্ব পুরুষের ভিটামাটি থেকে তাদের উত্খাত করা হচ্ছে অস্ত্রের মুখে। নির্বিচারে করা হচ্ছে হত্যা। এমন রক্তাক্ত বিশ্বের স্বপ্ন কি আমরা দেখেছিলাম? না, আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম এক শান্তিপূর্ণ বিশ্বের। আমরা কোনো জাতিগত নিধনযজ্ঞ কিংবা উত্খাত দেখতে চাইনি। আমরা স্বপ্ন দেখি ঐক্যবদ্ধ পৃথিবীর। যুদ্ধ নয়, আমরা শান্তি চাই।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আগেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। দীর্ঘ সময় ব্রিটিশ-পাকিস্তান সরকারের দুঃশাসনের কারণে এ দেশে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন নতুন করে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু করেন, তখন প্রায় শূন্য হাতেই শুরু করতে হয়েছিল। এই অগ্রযাত্রা প্রথম হোঁচট খায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ সময় গণতন্ত্রহীনতা ও স্বৈরাচারী সেনা শাসকদের কারণে এ দেশের উন্নয়ন তুমুলভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন প্রকৃত গণতন্ত্রের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন উন্নয়নের এ যাত্রা আবার শুরু হয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সব সেক্টরে উন্নয়ন হয়েছে আশাতীত। বর্তমানে শেখ হাসিনা সরকারের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ জীবনমানের সামাজিক সূচকগুলোতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর চেয়েও অনেক এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রের নাম। জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ অধিবেশনের এক ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শেখ হাসিনার কাছে বাংলাদেশের খবর জানতে চান। উত্তরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ খুব ভালো অবস্থায় আছে। তবে আমাদের একমাত্র সমস্যা মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীরা।
রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। আশির দশকের গোড়া থেকেই এ সমস্যা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাদের। ২০১২ সালেও সংবাদপত্রের মাধ্যমে রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারের খবর পাই আমরা। তবে এ বছর এই নির্যাতন-নিপীড়ন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অসংখ্য মানুষকে তারা হত্যাও করেছে। নির্যাতন-নিপীড়ন এতটাই প্রকট হয়েছে যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাত থেকে জীবন বাঁচাতে সাড়ে চার লাখ লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে এ দেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকার বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে, বাড়িয়ে দিয়েছে মানবতার হাত। অসহায় মানুষকে বাঁচাতে সীমান্ত বন্ধ না করে খোলা রেখেছে। অন্য একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিধনের হাত থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশের এমন মানবিক অবস্থান বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। গোটা বিশ্ব আজ শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনা পরিণত হয়েছেন বিশ্বনেতায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে ছুটে গিয়েছেন। নিজের হাতে অসহায়-ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন। এ জন্যই ব্রিটিশ গণমাধ্যম তাঁকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য কে কী করল সেটা নিয়ে তিনি চিন্তিত নন। তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমরা ধনী রাষ্ট্র নই, এটা সত্য। আমাদের ছোট ভূখণ্ডে ১৬ কোটি মানুষ বাস করে। আমরা যদি ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারি, কেন বাকি পাঁচ-সাত লাখ মানুষকে খাওয়াতে পারব না। প্রয়োজনে আমরা আমাদের খাবার ভাগ করে খেতে প্রস্তুত। এরই মধ্যে এ দেশের জনগণ তা-ই করছে। ’ জাতিসংঘের ৭২তম অধিবেশনে রাখাইনের গণহত্যা বন্ধের দাবিতে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশ্ব এখন তাঁর সঙ্গে। অসহায় রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ঘরে ফেরা তিনি নিশ্চিত করবেন। এ জন্যই তিনি ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’। আমরণ সবার জন্য একটি শান্তিপূর্ণ নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
লেখক : এস এম জাকির হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ।