দেশের প্রয়োজনে ছাত্রলীগ কখনও ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি: জাকির হোসাইন
দেশের প্রয়োজনে ছাত্রলীগ কখনও ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি- বললেন এস এম জাকির হোসাইন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সর্বকনিষ্ঠ সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন ২০১৫ সালে ছাত্রলীগের কাউন্সিলে বিপুল ভোটে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের দহপাড়ার হাফেজ মাওলানা আবদুল জলিলের ছেলে। নয় ভাইবোনের মধ্যে এস এম জাকির হোসাইন অষ্টম। স্থানীয় নয়াবাজার হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং নরসিংদী পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন। অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে এখন তিনি এমফিলে অধ্যয়নরত।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আজকের বিডির নিজস্ব প্রতিবেদক ।
আজকের বিডি: দুই বছর দায়িত্ব পালন করলেন। সংগঠনটির দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা হিসেবে অভিজ্ঞতা কেমন?
এস এম জাকির হোসাইন: ছাত্রলীগ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। এই সংগঠনের নেতা হতে পারাই বিশেষ অভিজ্ঞতা। ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন এবং পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। সেইসঙ্গে যখন ছাত্রদের অধিকারে শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপ এসেছে ছাত্রলীগ সেই জায়গায় অগ্রণী ভূমিকা রেখে ছাত্র সমাজের অধিকার রক্ষায় নেতৃত্ব দিয়েছে।
আমি এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। তবে আমার মনে দাগ কেটেছে একটি সংগঠনকে মানুষ কত ভালোবাসলে সেটি এত জনপ্রিয় হতে পারে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা ও দেশরত্ন শেখ হাসিনা আমাদের ছাত্রলীগের দায়িত্ব পালনে যেভাবে আদেশ-নির্দেশ দিয়েছেন আমরা সেভাবে দায়িত্ব পালন করতে চেষ্টা করেছি। কতটুকু করতে পেরেছি সেটা দলীয় নেতাকর্মী এবং আপনারা (গণমাধ্যম) ভালো বলতে পারবেন।
আজকালের খবর: আপনারা দায়িত্ব নেওয়ার পর ছাত্রলীগে কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সময়েও অনেক ঘটনা গণমাধ্যমে আসছে।
জাকির হোসাইন: বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অনেক বড় সংগঠন। এই সংগঠনের সব সদস্য সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। কেউ পারিবারিক, ব্যক্তিগত বা অন্য কোনো কারণে সমস্যায় পড়েন বা সমস্যা সৃষ্টি করেন। এসব বিষয় আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নেই। যারা দেশের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে যাওয়া কাজে যুক্ত হন তাদের সংগঠন থেকে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া আমাদের নিয়মিত কাজের অংশ।
আজকের বিডি: সম্প্রতি হওয়া ছাত্রলীগের সাধারণ সভায় কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বলে গণমাধ্যমে এসেছে।
জাকির হোসাইন: সাধারণ সভায় কেন্দ্রীয় নেতাদের বাইরে কেউ থাকতে পারেন না। এখানে সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে অত্যন্ত খোলামেলা আলোচনা হয়। নিজেদের মধ্যে অনেক ধরনের কথা হতে পারে, এটাই গণতান্ত্রিক চর্চা।
আজকের বিডি: কিছুদিন আগে হওয়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সভায় ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে সব ইউনিটের সম্মেলনের নির্দেশ দিয়েছেন আপনারা। এত কম সময়ে সেটা কীভাবে সম্ভব?
জাকির হোসাইন: এই সময়ের মধ্যে সব সম্মেলন সম্ভব হবে না। তবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ইউনিটের সম্মেলন হওয়ার তাগিদ দিয়েছি আমরা।
আজকের বিডি: আপনার কমিটির দুই বছর পূর্ণ হয়েছে । ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটির মেয়াদ দুই বছর। নেতাকর্মীরাও চাচ্ছেন সম্মেলন হোক, কী করবেন?
জাকির হোসাইন: ২৬ জুলাই আমাদের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। ছাত্রলীগ গণতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হয়। আমরা গঠনতন্ত্রের বাইরে নই। এরপরও জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল। ছাত্রলীগ তার ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করে। নেত্রী যখন চাইবেন তখনই সম্মেলন হবে। সময়ের প্রয়োজন ছাত্রলীগ সব সময়েই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের সম্মেলনও সংগঠনের স্বার্থে প্রয়োজন। সম্মেলনের মাধ্যমেই আমরা দায়িত্ব পেয়েছিলাম। নতুন সম্মেলনের মাধ্যমে আগামী দিনের নেতৃত্ব নির্বাচিত হবেন।
আজকের বিডি: গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও ‘নেত্রীর নির্দেশনা’ চাওয়াকে অনেকে সময়ক্ষেপণ বলে অভিহিত করেন।
জাকির হোসাইন: সব সময়েই এটা হয়ে আসছে। গত কমিটির সময়েও সম্মেলন ঠিক করার সময় নেত্রীর পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল। আমরাও তাই করব।
আজকের বিডি: আপনাদের নেত্রীই তো গঠনতন্ত্র অনুমোদন করে দিয়েছেন …
জাকির হোসাইন: ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে নেত্রী উপস্থিত থাকেন। তাই এখানে অনেক কিছু বিবেচনা করে সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ হয়। আবার নেত্রী যদি মনে করে বিদ্যমান কমিটি আরও কিছুদিন থাকবে, তাহলে এই কমিটি আরও কিছুদিন থাকবে। সব সময় এরকমই হয়ে আসছে।
আজকের বিডি: আগামী কমিটিতে পদ প্রত্যাশীরা বলছেন, সম্মেলন ঠিক সময়ে না হলে বয়সের বাঁধা-ধরা নিয়মও থাকা উচিত নয়।
জাকির হোসাইন: বয়সের বিষয়টি আমাদের গঠনতন্ত্রে রয়েছে। গঠনতন্ত্রে ২৭ বছর বয়সের কথা লেখা থাকলেও নেত্রীর নির্দেশে সেটা ২৯ বছর ধরা হয়। এরচেয়ে বেশি বাড়ানো হবে বলে মনে হয় না।
আজকের বিডি: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অভিজ্ঞ হিসেবে বর্তমান কমিটির থাকা প্রয়োজনের কথাও আলোচিত হচ্ছে।
জাকির হোসাইন: আমি এটা যুক্তিযুক্ত মনে করি না। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সব সময় প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচন করেছে। ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের নেতা নির্বাচনে কখনো ভুল করেনি। তাই আগামী কাউন্সিলে যারা নেতৃত্বে আসবেন তারা আমাদের থেকে আরও বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন হবেন বলে আমি আশা করি। তবে অভিজ্ঞতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কাজ করতে করতেই মানুষ অভিজ্ঞ হয়।
আজকের বিডি: নব্বই পরবর্তী ছাত্ররাজনীতিতে ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে।
জাকির হোসাইন: ওয়ান-ইলেভেনে নেত্রীকে গ্রেফতারের পর প্রথম আন্দোলনের সূচনা করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ওই সময়ের সেনাশাসিত সরকারের বিরুদ্ধেও ছাত্রলীগের অনেক নেতা আন্দোলন করে গ্রেফতার ও মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। হেফাজতে ইসলাম যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল তখন ছাত্রলীগের উদ্যোগে প্রতিবাদ শাহবাগে অনুষ্ঠিত হয়। সমাজের সর্বস্তরের জনগণ ওই আন্দোলনে নিজেদের যুক্ত করে। সরকার আইন সংশোধন করে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেয়, যেটা বিশ্বের ইতিহাসে বড় একটি ঘটনা। এছাড়া ২০১৫ সালে বিএনপি জামায়াতের পেট্রলবোমা হামলায় যখন সারা দেশে মানুষ পুড়ছিল তখন প্রশাসনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী দুষ্কৃতকারীদের ধরে পুলিশের হাতে দিয়েছে, কেউ কেউ পুরস্কারও পেয়েছে। তাই আমি মনে করি একটি সংগঠনের অনেক ইতিবাচক কাজ আছে যেটা মিডিয়াতে ঠিকভাবে আসে না। কিন্তু নেতিবাচক বিষয়গুলো বেশি আসে। আপনি দেখবেন, দেশের প্রয়োজনে ছাত্রলীগ সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে, কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না।
আজকের বিডি: শুধুমাত্র ছাত্রদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে ছাত্রসংগঠনগুলো কেমন অবদান রাখতে পারছে।
জাকির হোসাইন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ১৮ দফা কর্মসূচি দিয়েছিল। আমরা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দাবি আদায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২ দফা এভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করেছি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নতুন ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল, ছাত্রলীগ সেই আন্দোলন সফল করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন ক্যাম্পাস বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। এভাবে ছাত্র সমাজের সব প্রয়োজনে ছাত্রলীগ সাংগঠনিকভাবে ইতিবাচক অবদান রাখার চেষ্টা করে।
আজকের বিডি: কিন্তু নব্বই পরবর্তী সময়ে মূল রাজনীতি মোটামুটি পথ চললেও ছাত্ররাজনীতির আঁতুরঘর ডাকসু তো বন্ধ হয়ে গেল …
জাকির হোসাইন: আমরাও ডাকসু নির্বাচন চাই। কিন্তু কী অজানা কারণে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে না তা আমি জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়েন। এখানে সার্টিফিকেটের পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ সব বিষয়ে ছাত্রদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জনে ডাকসু চালু হওয়া উচিত। আমাদের সম্মানিত শিক্ষকরা সিনেটে তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু ছাত্রদের দাবি নিয়ে কথা কেউ বলেন না। তাই আমি মনে করি অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচন দেওয়া উচিত। আমার নিজের এখনো ছাত্রত্ব আছে। ডাকসু নির্বাচন হলে আমি নির্বাচন করতে পারি।
আজকের বিডি: রাজনীতির অনেক বিষয় এখন আদালতে ফয়সালা হচ্ছে। ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী সব ছাত্র সংগঠনই ক্ষমতাসীন দলের অন্ধ অনুসরন করে। সংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ছাত্র সংগঠনগুলো কথাই বলে না।
জাকির হোসাইন : আমি এটা মনে করি না। আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী যখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করেছিলেন সেখানে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিয়ে প্রতিবাদ করেছে। সংবিধানসহ জাতীয় ইস্যুগুলোতে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সিনিয়র নেতারা আছেন তারা কথা বলবেন। আমরা ছাত্রদের বিষয় নিয়েই মূল দায়িত্ব পালন করব।
আজকের বিডি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ইউনিট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ইউনিটের সম্মেলন কবে হবে?
জাকির হোসাইন: কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়েও নেত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।
আজকের বিডি: দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এমন বিশেষ কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন কি, যা আপনার মনে দাগ কেটেছে।
জাকির হোসাইন: কিছু দিন আগে নীলফামারীর ডিমলায় গিয়েছিলাম। ভোর রাত প্রায় চারটার দিকে আমরা গন্তব্যে পৌঁছাই। দেখলাম ডিমলা এলাকার প্রায় চার-পাঁচশ মানুষ আমাকে দেখার জন্য এত রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন। এর মধ্যে অনেক বৃদ্ধ মহিলাও আছেন। সেদিন নিজের মধ্যে বিশেষ অনুভূতি কাজ করেছিল। আমি জানি তারা ব্যক্তি জাকিরকে দেখতে আসেননি। তারা এসেছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিরকে দেখতে। এই পদ আমাকে রাজনীতির যে অভিজ্ঞতা দিয়েছে তা আর কোনোভাবে পাওয়া সম্ভব না। বঙ্গবন্ধু কন্যার স্নেহের আঁচলে রেখে আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন সে ঋণ কোনো দিন কোনোভাবেই শোধ করার মতো নয়। আমি সারাজীবন একজন কর্মী হিসেবে আমি আমার কাজ করে যেতে চাই।